ঢাকা,শনিবার, ৪ মে ২০২৪

খাদ্য বিভাগ: ‘চেটেপুটে’ খাচ্ছে ৪ সিন্ডিকেট

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ::  ব্যবসায়ীর গুদামে সরকারি চাল আটক, ডিও ব্যবসার আড়ালে গুদামের চাল পাচার ও গুদামে ভালোমানের বস্তা পাল্টানোর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখন যুক্ত হয়েছে আমদানি করা সরকারি চাল নিয়ে কারসাজি। আমদানি করা উন্নতমানের চালের বস্তা পাল্টিয়ে নিম্নমানের চাল ভরে গুদামে পৌঁছানো, আমদানি করা নিম্নমানের চাল গ্রহণের অভিযোগ। ইতিমধ্যে দুই দফায় নিম্নমানের চাল খালাস বন্ধও করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, খাদ্য বিভাগে জেঁকে বসা ‘ভূত’ই চেটেপুটে খাচ্ছে খাদ্য বিভাগকে।

খাদ্য বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার, গুটিকয়েক অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী-এই চার শ্রেণির সিন্ডিকেট মিলে গিলে খাচ্ছে খাদ্য বিভাগকে।

গত ২১ এপ্রিল নগরীর পাহাড়তলী বাজার থেকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির সরকারি ৭০ হাজার কেজি চাল জব্দ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় চাল ব্যবসায়ী বাহার মিয়াকে। পরবর্তীতে বাহার মিয়ার গুদাম তল্লাশি করে প্রায় ২২শ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে এসব চাল নোয়াখালীর চরভাটা এলএসডি খাদ্য গুদামে যাওয়ার কথা ছিল। চাল পাচারের নেপথ্যে ছিল পরিবহন ব্যবসায়ী খোকন কান্তি দাশ। পরে পরিবহন ঠিকাদার খোকন দত্তকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

এ ঘটনায় খাদ্য বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সুনীল দত্ত পূর্বকোণকে বলেন, ‘চরভাটায় চার ট্রাক চাল পৌঁছানোর কথা ঠিকাদারের। কিন্তু এক ট্রাক চাল পৌঁছেনি। আমরা এ বিষয়ে রিপোর্ট দিয়েছি’।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, সরকারি উন্নতমানের চাল পথিমধ্যে নামিয়ে বস্তা বদল করে নিম্নমানের চাল-ভর্তি করে খাদ্য গুদামে পাঠানোর তথ্য ছিল। কিন্তু আমাদের হাতে তথ্য প্রমাণ না থাকায় তদন্ত প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করতে পারিনি। তিনি বলেন, আমদানি করা চালের জাহাজ বন্দরে আসার পর বস্তার ধরণ ও সিল ছবি-ভিডিও করে নেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরে হুবহু বস্তা তৈরি করে নিম্নমানের চাল ভরে প্রস্তুত রাখা হয়। বন্দর থেকে খাদ্য গুদামে পৌঁছানোর সময় পথে নামিয়ে নিম্নমানের চাল ভর্তি বস্তা একই ট্রাকে করে সংশ্লিষ্ট গুদামে পৌঁছানো হয়। খাদ্য বিভাগ, গুদাম ও বন্দর থেকে চাল খালাসে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পরিবহন ঠিকাদার, অসাধু ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগী একটি চক্রের বিরুদ্ধে বস্তা পাল্টানোর অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ পর্যন্ত ছয় লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করেছে সরকার। আমদানি করা এসব চালের মধ্যে কী পরিমাণ বস্তা পাল্টানো হয়েছে তা বের করতে পারেনি খাদ্য বিভাগের তদন্ত কমিটি।

২০২০ সালের এপ্রিলে পাহাড়তলী বাজার থেকে ২১ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল আটক করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চাল ব্যবসায়ী মেসার্স ফারুক ট্রেডার্স থেকে তা উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও ১৫শ খালি বস্তা ও ৯ হাজার চটের বস্তা উদ্ধার করা হয়। সরকারি চালের বস্তা পাল্টিয়ে নুরজাহান ব্রান্ডের বস্তায় ভরে বাজারজাত করার সময় জব্দ করেছিল পুলিশ। খাদ্য বিভাগের সরকারি চাল বার বার ধরা পড়ার পরও অদৃশ্য কারণে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বাঘববোয়ালরা।

গত ৮ মে ভারত থেকে আমদানি করা চালের মান খারাপ হওয়ায় জাহাজ থেকে খালাস বন্ধ করে দিয়েছে খাদ্য বিভাগ। ওই জাহাজে প্রায় ১৯ হাজার টন চাল ছিল। এসব চালের মধ্যে কিছু কিছু বস্তায় অতিরিক্ত ভাঙা চাল থাকায় খালাস বন্ধ করা হয়েছে। তবে পরবর্তীতে লাইটার জাহাজে করে সাইলো জেটিতে তা খালাস করা হয়েছিল। এসব চাল দেশের বিভিন্ন খাদ্য গুদামে সংরক্ষণের কথা ছিল। কিন্তু তা না করে শেষতক নগরীর হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য চলাচল ও সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মো. শফিউল আজম বলেন, ‘যাচাই-বাছাই করে ভাঙা চাল ফেরত নিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। মান বাছাই করে খালাস করা হয়েছে’।

গত ৫ আগস্ট আবারো ধরা পড়ল নিম্নমানের চাল আমদানি। ভারত থেকে আমদানি করা নিম্নমানের চাল খালাস বন্ধ করে দিয়েছে খাদ্য বিভাগ। ওই জাহাজে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার টন চাল রয়েছে। ১৮ হাজার দুইশ টন চাল নিয়ে বন্দর জেটিতে ভিড়ে এমভি ড্রাগন। বেশির ভাগ চাল ছিল লালচে ও ঘোলাটে।

একাধিক পরিবহন ঠিকাদার জানান, আমদানি করা জাহাজের মধ্যে প্রায় নিম্নমানের চাল থাকে। চাল খালাসে জড়িত খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভালোমানের চালের সঙ্গে নিম্নমানের চালও গ্রহণ করা হয়। ঠিকাদারের দাবি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সুবিধা নিয়ে প্রতিনিয়ত এ অনৈতিক কাজ করে থাকেন। এজন্য বিভিন্ন গুদামে চাল পরিবহনের সময় ঠিকাদারদের ভোগান্তি পোহাতে হয়।

একাধিক সূত্র জানায়, দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্য গুদামের উন্নতমানের সরকারি চাল পাল্টিয়ে নিম্নমানের চাল পাচারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ডিও ব্যবসার আড়ালে পাহাড়তলী ও চাক্তাইকেন্দ্রিক ৫-৭ জনের একটি অসাধু সিন্ডিকেট এই গোঁজামিল করে আসছেন। বিশেষ করে পাহাড়তলী চাল বাজারের তিন ব্যবসায়ী হচ্ছেন চাল পাল্টানো সিন্ডিকেটের প্রধান হোতা। ইতিমধ্যেই খাদ্য গুদাম থেকে চাল পাচার ও ব্যবসায়িক গুদাম থেকে সরকারি চালও উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বছরের পর বছর ধরে এ কারসাজি চলে আসলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার ও খাদ্য বিভাগ। এতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে চাল পাচারকারী সিন্ডিকেট।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু নঈম মো. শফিউল আজম ইতিমধ্যেই বলেন, ‘খাদ্য বিভাগের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করছি’।

২০১৭ সালে হালিশহর সিএসডি গুদাম থেকে চাল পাচারকালে বিপুল পরিমাণ চাল আটক করেছিল র‌্যাব। এসময় গুদাম ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা ও সহকারী ম্যানেজার ফখরুল আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে চাল পাচার ও কারসাজির বিষয়টি প্রকাশ পায়। তারপরও তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে সরকারি চাল নিয়ে লুটপাটও বন্ধ হচ্ছে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

পাঠকের মতামত: